রাজধানীতে সড়কের মোড়ে মোড়ে সিগন্যাল বাতি, ট্রাফিক পুলিশ ও ফ্লাইওভার নির্মাণ করেও যানজট কমানো সম্ভব না হওয়ায় এবার বেশকিছু এলাকায় রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করে যানজট নিরসনের পদক্ষেপ নিয়েছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর ভবনে ডিটিসিএর (ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কন্ট্রোল অথরিটি) এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্তে রাজধানীর দুটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধ করা হয়। গত রোববার থেকে প্রগতি সরণির কুড়িল বিশ্বরোড থেকে রামপুরা মালিবাগ, হয়ে খিলগাঁও-সায়েদাবাদ এবং মিরপুর রোডের গাবতলী থেকে আসাদগেট, ধানমন্ডি হয়ে আজিমপুর পর্যন্ত রিকশা ও ভ্যান চলাচল করতে পারবে না বলে জানানো হয়। তবে মূল সড়ক ছাড়া অন্য সড়কগুলোতে রিকশা চলবে। যদিও বৈঠকে রিকশা চলাচল বন্ধের পাশাপাশি এই দুটি সড়কে পর্যাপ্ত গণপরিবহন চালু করার জন্য বিআরটিসি এবং বাস মালিক সমিতির প্রতি আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু ডিএনসিসিকে মনে রাখতে হবে, বিআরটিসি ও মালিকদের বাস চলাচলের আহবান জানালেই সর্বসাধারণের যাতায়াতের সমস্যার সমাধান হয়ে যায়নি। যানজট নিরসনে রাজধানীর প্রধান সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত সঠিক হলেও, আগে যাত্রীদের কথা ভেবে বিকল্পের ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন-রামপুরা, মালিবাগ, খিলগাঁও, সায়েদাবাদ এবং মিরপুর রোডের গাবতলী থেকে আসাদগেট, ধানমন্ডি, আজিমপুর এসব রুটে লোকাল বাসে অসহনীয় যাত্রীর চাপ থাকে। একজন সুস্থ মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও স্বাভাবিকভাবে ওঠার কোনো বাস পাবেন না। আর সেখানে বয়োবৃদ্ধ, অসুস্থ, শিক্ষার্থী, অফিসগামী কিংবা মহিলাদের কী অবস্থা হবে সংশ্লিষ্টরা ভেবে দেখেছেন কী? এসব রুটে অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে বাধ্য হলেও রিকশা ছাড়া বিকল্প নেই।
ঢাকায় যানজট কমাতে চাইলে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে শুধু রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করেই নয়, একই সঙ্গে প্রাইভেটকারও নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। ঢাকায় বর্তমানে প্রাইভেটকার ২ লাখ ৪৯ হাজার। ঢাকার রাস্তা ৮০ ভাগ প্রাইভেটকারের দখলে থাকে। যাত্রী বহন করে মাত্র ৮ ভাগ। রিকশা যাত্রী বহন করে ৩২ ভাগ। ঢাকায় রিকশা প্রাইভেটকারের চেয়ে কার্যকর। কারণ গতির দিক দিয়ে ঢাকায় গড় গতি ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার। অথচ রাজধানীর রিকশার ওপর বারবার খড়গ নেমে আসলেও প্রাইভেটকার ঠেকাবে কে? সড়ক গতিশীল ও যানজটমুক্ত করতে গণপরিবহন সহজলভ্য করে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। গণপরিবহন যে রাস্তায় যতটুকু আছে সেগুলোর সেবার মান প্রশ্নবিদ্ধ ও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল! এ কারণে বিত্তবান ও মধ্যম আয়ের মানুষ বাধ্য হয়েই ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। হঠাৎ করে এসব সড়কে রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ কার্যকর হওয়া মানে, অসহায়-দরিদ্র রিকশাচালকদের পেটে লাথি মারা।
মাতা-পিতাসহ ৫/৭ জনের ভরণ-পোষণের ভার নিয়ে অনেকেই রিকশা চালিয়ে রোজগার করে থাকে। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচসহ অসুখ-বিসুখের ব্যয়ভার নিয়ে তাদের সংসার চালাতে হয়। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে রিকশা চালকের বিষয়ে বিকল্প কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করার বিষয়ে ভাবা দরকার। সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারে দাবিতে ইতোমধ্যে ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় রিকশা চালকরা অবরোধ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছে। ঢাকা মহানগরীর রিকশাচালকদের জীবন-সংগ্রাম, দেশের পণ্য ও নাগরিক পরিবহনে তাদের প্রয়োজনীয়তা, অবদান এবং সংগঠিতকরণ বিষয়ে পরিচালিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)। সেখানে বলা হয়, ঢাকা শহরের অন্তত ৬০ শতাংশ মানুষ রিকশায় চড়ে। রিকশাচালকদের মাসিক গড় আয় ১৩ হাজার ৩৮২ টাকা। রিকশাচালকরা অত্যন্ত দরিদ্র। প্রায় এক-তৃতীয়াংশের কোনো জমি নেই। ঢাকায় রিকশা চালনা শুরু করার আগে বেশিরভাগই (৫৭.১ ভাগ) ছিল দিনমজুর, ১৩.৮ ভাগ যুক্ত ছিল ক্ষুদ্র ব্যবসায়, ১২.১ ভাগ কৃষিকাজে। রিকশাচালক হিসেবে কাজে আসার পেছনে প্রধান কারণ ছিল অন্য কোনো কর্মসংস্থানের অভাব এবং এই পেশায় আসতে উৎসাহের কারণ ছিল এতে কোনো পুঁজি ও দক্ষতার প্রয়োজন নেই। রাজধানীতে স্বল্প দূরত্বের মানুষ যে হেটে যাতায়াত করবে সে ব্যবস্থাও নেই।
সড়ক ও ফুটপাতগুলো হকারদের অবৈধ দখল ও পার্কিংয়ে ভরপুর। জনদুর্ভোগ লাঘব এবং সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে, জনগণের চলাচল নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতে, ফুটপাত ও সড়কে রাখা নির্মাণ সামগ্রী, দোকান এবং রাজনৈতিক পরিচয়ে স্থাপনা সরিয়ে নেয়ায় কঠোর ব্যবস্থা নিন…?